শনিবার, ৬ মে, ২০১৭

মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা) এর ‘আত তাহিয়াতু’ লাভ করার মিথ্যা, ভিত্তিহিন ও বানোয়াট একটি কাহিনী


  মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা) এর ‘আত তাহিয়াতু’ লাভ করার মিথ্যা, ভিত্তিহিন ও বানোয়াট একটি কাহিনী

সর্বপ্রথম মি’রাজ সম্পর্কে আমরা আমাদের অবস্থান পরিস্কার করছি। আমরা বিশ্বাস করি, মি’রাজ রাসূল (সা) এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জেজা। রাসূল (সা) কে মহান আল্লাহ তায়ালা সশরীরে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে গিয়েছেন। আমরা মি’রাজ সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত প্রত্যেকটা বক্তব্য বিনা বাক্য ব্যায়ে, বিনা যুক্তিতে ঈমান রাখি।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মি’রাজ সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) যেখানে থেমে গেছেন, আমরাও সেখানে থেমে যাই। নিজেদের পক্ষ থেকে কল্পনার ঘোড়া ছুটাই না। এবং বিশুদ্ধ বর্ণনা ছাড়া কাল্পনিক কোন কিছু বর্ণনা করাকে চরম গর্হিত কাজ বলে মনে করি। আশা করি সম্মানিত পাঠকদের কাছে সংক্ষিপ্তভাবে মি’রাজ সম্পর্কে আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি ।


আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মি’রাজকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্যের ছড়াছড়ি রয়েছে। অনেক বই পুস্তকে এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর কিছু ওয়ায়েজিন সম্ভবত অজ্ঞতা বশত অথবা শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার আশায় এই সমস্ত বানোয়াট কিসসা কাহিনী বর্ণনা করে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করেন। এরকম অসংখ্য অগনিত বানোয়াট কাহিনীর মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত কাহিনী হচ্ছে, মি’রাজে রাসূল (সা)-এর ‘আত-তাহিয়াতু’ লাভ।

মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা) এর ‘আত তাহিয়াতু’ লাভ করার ভিত্তিহিন কাহিনী
আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত কথা হল, রাসূল (সা) মি’রাজের রাত্রিতে ‘আত-তাহিয়াতু’ লাভ করেন। এবং মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা) এর সাথে আল্লাহর সর্বপ্রথম যে কথা হয়েছিল তা ছিল ‘আত-তাহিয়াতু’।

এ বিষয়ে প্রচলিত একটি গল্পঃ গল্পটির সার-সংক্ষেপ হল, রাসূল (সা) যখন মি’রাজের রাত্রিতে যখন সর্বচ্চ নৈকট্যে পৌঁছান তখন মহান আল্লাহকে সম্ভাষণ করে বলেনঃ ‘আত-তাহিয়াতু লিল্লাহি…’ তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘আস-সালামু আলাইকা…’ তখন রাসূল (সা) চান যে, তাঁর উম্মাতের জন্যও সালামের অংশ থাকুক। এজন্য তিনি বলেনঃ ‘আসসালামু আলাইনা ওয়া…’ তখন জিবরীল (আঃ) ও সকল আকাশবাসী বলেনঃ ‘আশহাদু…’; কোন কোন গল্পকার বলেনঃ আস-সালামু আলাইনা…’ বাক্যটি ফেরেশতাগন বলেন।

ইমাম কুরতুবী বলেনঃ এ গল্পটির কোন ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। কোথাও কোনো গ্রন্থে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে বলেও জানা যায় না। মি’রাজের ঘটনা বিভিন্ন হাদীস ও সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সনদসহ বর্ণনায় মি’রাজের ঘটনায় এ কাহিনীটি বলা হয়েছে বলে আমি দেখতে পাইনি। সনদবিহীন ভাবে কেউ কেউ তা উল্লেখ করেছেন।
– কুরতুবী, তাফসীর ৩/৪২৫

বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে, সাহাবীগণ সলাতের শেষ বৈঠকে সালাম পাঠ করতেনঃ ‘আল্লাহকে সালাম, নাবীকে সালাম, জিবরীলকে সালাম’; তখন রাসূল (সা) তাদেরকে বললেনঃ ‘এভাবে না বলে তোমরা আত-তাহিয়াতু… বলবে। সকল হাদীসেই এইরুপ বলা হয়েছে। কোনো হাদীসেই বলা হয়নি যে, ‘আত-তাহিয়াতু’ মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা) লাভ করেছেন।

আত-তাহিয়াত-কে তাশাহুদ বলা হয়, সহীহ হাদীসে তাশাহুদের বর্ণনা

শাকীক ইবন সালামাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রা) বলেন, আমরা নাবী (সা) এর পিছনে সলাত আদায়কালে বলতাম, ‘আসসালামু আলা জিবরীল, ওয়া মিকাঈল এবং আসসালামু আলা ফুলান ওয়া ফুলান’। তখন রাসূল (সা) আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

“আল্লাহ নিজেই তো সালাম, তাই তোমাদের কেউ সলাত আদায়কালে যেন বলে – আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াসসলাওয়াতু ওয়াত-ত্বাইয়েবাতু, আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস স্বলেহিন।”

অর্থাৎ আমাদের সব সালাম ও অভিবাদন, সলাত ও দু’আ এবং পবিত্রতা মহান আল্লাহর জন্য। হে নাবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ বর্ষিত হোক। আমাদের ও আল্লাহর সকল নেক বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

কেননা তোমরা যখন এটা পাঠ করবে তখন তা আসমান ও যমিনের মাঝে যত নেক বান্দা আছে সবার নিকটেই পৌঁছে যাবে। আর সাথে এটাও পড়বে ‘আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ’।
অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি সাক্ষ্য আরও দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।
– বুখারী ৮৩১, ৬২৩০, ৬৩২৮, ৭৩৮১; মুসলিম ৪০২; আবু দাউদ ৯৬৮; ইবন মাযাহ ৮৯৯; নাসাঈ ১১৬৮, ১১৬৯; বুলুগুল মারাম ৩১৪; তিরমিযি ২৮৯; আহমাদ ৭০৮, ৭১৩; মিশকাতুল মাসাবীহ ৯০৯; দারিমী ১৩৪০,১৩৪১, ১৩৪৬; ইবন খুজায়মাহ ৭০৪; ইরওয়া ৩৩৬

রাসূল (সা) তাশাহুদকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার মতো গুরুত্ব দিয়ে সাহাবীগণকে তা শিক্ষা দিতেন

আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রা) বলেনঃ

“রাসূল (সা) আমার হাত তাঁর উভয় হাতের মধ্যে নিয়ে আমাকে তাশাহুদ শিক্ষা দিয়েছেন, যেভাবে তিনি আমাকে কুরআনের সুরা শিক্ষা দিতেন।’’
– বুখারী ৬২৬৫; মুসলিম ৪০২; আহমাদ ৭০৯, ৭১০, ৭১২

ইবন আব্বাস (রা) বলেনঃ

রাসূল (সা) আমাদেরকে যেভাবে কুরআনের সুরা শিক্ষা দিতেন, ঠিক সেইভাবে আমাদেরকে তাশাহুদ শিক্ষা দিতেন।’’
– মুসলিম ৪০৩

হে সম্মানিত পাঠক! চিন্তা করে দেখুন, রাসূল (সা) আত-তাহিয়াত বা তাশাহুদকে কত গুরুত্ব দিয়ে সাহাবীগণকে শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তিনি বলেননি যে, মি’রাজের রাত্রিতে আল্লাহর সাথে আমার যে কথোপকথন হয়েছিল এটা সেই বাক্য!’’

মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সা)-এর সাথে মহান আল্লাহর কথোপকথনের বিস্তারিত বর্ণনা হাদীস ও সিরাত গ্রন্থসমুহের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু কোনো একটা হাদীস গ্রন্থে সনদসহ মি’রাজে রাসূল (সা) আল্লাহর সাথে ‘আত-তাহিয়াত’ বলে কথা শুরু করেছেন বলে উল্লেখ নেই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বর্ণনা থেকে হিফাযত করুন।

মিরাজের রাত্রিতে তাশাহুদ নয়, সুরা বাকারার শেষ দু’টি আয়াত রাসূল (সা)-কে দেয়া হয়েছিল

আবদুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ

রাসুলুল্লাহ (সা) যখন মি’রাজ রজনীতে ষষ্ঠ আসমানে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত আরোহণ করানো হল। যেখানে শেষ হয় পৃথিবী থেকে যা উপরে উঠে এবং সেখান থেকে তা গ্রহন করা হয়। তদ্রুপ ঊর্ধ্বলোক থেকে যা কিছু অবতরন হয় তাও এ পর্যন্ত এসে পৌঁছে এবং সেখান থেকে তা গ্রহন করা হয়। এরপর আবদুল্লাহ (রা) তিলাওয়াত করলেনঃ

যখন গাছটি যা দিয়ে ঢেকে থাকার তা দিয়ে ঢাকা ছিল (যার বর্ণনা মানুষের বোধগম্য নয়)।
– সূরা আন নাজম ৫৩/১৬

তিনি বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ (সা) কে তিনটি জিনিস দান করা হলঃ পাঁচ ওয়াক্ত সলাত, সুরা বাকারার শেষ আয়াতদ্বয় এবং তাঁর উম্মতের এমন ব্যক্তির জন্য ক্ষমা, যে কাউকে বা কোনো কিছুকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে না।’’
– মুসলিম ২৭৯-(১৭৩); নাসায়ী ৪৫১

সহায়ক গ্রন্থঃ
০১. তাফসীর, ইবন কাসীর। বাকারাহ ২/২৮৫-২৮৬ দ্রষ্টব্য।
০২. হাদীসের নামে জালিয়াতি, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির; পৃষ্ঠা নঃ ৩৫৩-৩৫৪
০৩. ইসরা ও মি’রাজ, মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান ও মাওলানা মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মুমিন। গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার; গবেষণাপত্র-৩; পৃষ্ঠা নঃ ৫৬

 সংগৃহীতঃ
সংকলনঃ সত্যান্বেষী রিসার্চ টীম
পরিবেশনায়ঃ সত্যান্বেষী রিসার্চ টীম
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন