বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭

শবে বরাত নিয়ে জাল/জয়ীফ হাদীসের নমুনা

শবে বরাত নিয়ে জাল/জয়ীফ হাদীসের নমুনাঃ

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের আরবী বোঝার ক্ষমতা নাই, আর কুরআন-হাদীস সব হলো আরবীতে। তাই শরীয়ত জানার জন্য আমাদের অনেকেই বেদাতীদের অনুবাদ করা কিতাবের বা বেদাতীদের লেখা বইপত্র (যেমন বেহেশতি যেওর, মকসুদুল মুমিনিন, ফাযায়েলে আমল, নেওয়ামুল কুরআন সহ অন্যান্য বেদাতি বই পুস্তক) পড়ে। কোন ব্যক্তি যদি কানা হয়, তাহলে বেদাতীরা তাকে কুঁড়েঘর দেখিয়ে হাইকোর্ট বলে চালিয়ে দেবে, আর তিনি সেটা অন্ধ বিশ্বাসে মেনে নিবেন – এটাই সত্যি এবং স্বাভাবিক।
.
চলুন আজকে আমরা এমন একটা ঘটনা দেখি, যেখানে বেদাতী হুজুরেরা হাদীসের নামে প্রতারণা করে শবে বরাতের রাতে হালুয়া-রুটি খাওয়ার ধর্ম চালু করেছে।
.
শবে বরাত নিয়ে সুনানে তিরমিযীতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আর হাদীসটি একই সনদে সুনানে ইবনে মাজাহ সহ আরো দুই-একটা হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি নিন্মরূপ।

.
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, একবার আমি রাতের বেলায় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হঠাত্‍ আমি দেখতে পেলাম যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে অবস্থান করছেন। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি আল্লাহ ও রাসুলের পক্ষ থেকে তোমার উপর কোন জুলুমের আশংকা করছ? আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ)! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন বিবির ঘরে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ তায়ালা ১৫ই শাবানের রজনীতে দুনিয়ার আসমানে (অর্থাত্‍ প্রথম আসমানে) অবতরণ করেন এবং বনী ক্বালব নামক গোত্রের বকরীসমূহের পশমের চাইতেও বেশি সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।
.
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শবে বরাতের রাতে কবর জিয়ারত করছেন আর এর ফযীলতের কথা বলছেন! তাহলে অনেকেই কেনো শবে বরাত পালন করাকে বেদাত বলছেন?
.
এবার আপনি হতভম্ব, কার কথা বিশ্বাস করবেন? সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরেকটু যাচাই করুন।
.
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) তার হাদীসের গ্রন্থে যে স্থানে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, ঠিক তার নীচে নিজেই হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য লিখেছেনঃ
“আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এই হাদীস আমি এই সনদ ছাড়া অন্য কোনো সূত্রের কথা জানিনা। এই হাদীসটি আমি হাজ্জাজ বিন আরকার কাছ থেকে, হাজ্জাজ ইহইয়া ইবনে কাসীর থেকে, ইহইয়া উওরওয়া থেকে, উরওয়া আয়িশাহ থেকে), এই সনদে জেনেছি। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী রহঃ কে, যিনি ইমাম তিরমিযির ওস্তাদ ছিলেন), এই হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞাস করেছিলাম। তিনি (ইমাম বুখারী) এই হাদীসটিকে জয়ীফ (দুর্বল) বলতেন। এই হাদীসটি দুর্বল একারণে যে, এই হাদীস ইহইয়া বিন কাসীর উরওয়া থেকে বর্ণনা করেছেন কিন্তু ইহইয়া উরওয়া থেকে এই হাদীস শুনেননি।”
এখানে ইমাম বুখারী বলতে চাচ্ছেন, দুই জন বর্ণনাকারী রাবীর মাঝে বিচ্ছিন্নতা আছে অর্থাৎ ইহইয়া উরওয়ার কাছ থেকে সরাসরি শুনেননি, মাঝখানে অন্য আরেকজন আছে যার নাম হাদীসের সনদে উল্লেখ করা হয়নি। এই ধরণের হাদীসকে ‘মুনকাতা’ (সূত্র বিচ্ছিন্ন) বলা হয়, যার কারণে হাদীসটি ‘জয়ীফ’ বলে গণ্য হয়। হাদীস মুনকাতা হলে সমস্যা হলো, এই হাদীসের সনদের মাঝখানে একজন অজ্ঞাত রাবী আছে, হতে পারে সে মুনাফেক, ধর্মের শত্রু, মিথ্যুক বা জাল হাদীস প্রচারকারী, অথবা সে সত্যবাদী। এই সন্দেহের জন্য হাদীসটি জয়ীফ, আর সন্দেহযুক্ত জিনিস শরীয়তে দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না।
.
এছাড়া এই হাদীসটি জয়ীফ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, হাজ্জাজ ইহইয়ার কাছ থেকেও সরাসরি শুনেননি। 
.
তৃতীয় কারণ, মুহাদ্দিসদের (হাদীস বিশেষজ্ঞ) নিকট হাজ্জাজ হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে নিজেই জয়ীফ, তাই তার বর্ণিত হাদীসও জয়ীফ।
.
সুতরাং, শবে বরাতের রাতে কবর জিয়ারত একটি ভিত্তিহীন আমল – কারণ এর পক্ষে সহীহ কোন হাদীসের দলীল পাওয়া যায়না।
.
আমাদের দেশি কিছু হুজুর মাওলানাদের মিথ্যাচার ও ভন্ডামী প্রসঙ্গেঃ 
‘মীনা বুক হাউস’ থেকে প্রকাশিত সুনানে তিরমিযীর অনুবাদে শুধু হাদীসটা কোট করা হয়েছে, কিন্তু ইমাম তিরমিযী ও ইমাম বুখারী যে হাদীসটিকে জয়ীফ বলে আলোচনা করেছেন, সেই অংশটুকু তারা গায়েব করে দিয়েছে। কারণ, সেই অংশ অনুবাদ করলে সাধারণ মানুষ জেনে যাবে, শবে বরাত সম্পর্কিত এই হাদীস সহীহ না, সুতরাং হালুয়া রুটি খাওয়া ধর্ম হতে পারেনা। আর এইরকম প্রতারণাপূর্ণ হাদীসের অনুবাদ পড়ে জামাতুল আসাদ ওরফে “জামাতুল ফাসাদ” এর মতো মুফতিরা এই হাদীস বর্ণনা করে শবে বরাত সম্পর্কিত বেদাতী আমল প্রচার করে থাকে। আমাদের দেশের অন্য একটি প্রকাশনী, তাওহীদ পাবলিকেশানের অনুবাদে তিরমিযিতে বর্ণিত উক্ত হাদীসের আরবীসহ বাংলা অনুবাদ করেছে। প্রমান হিসেবে আমি দুইটি অনুবাদের স্ক্রীনশট ছবিতে পাশাপাশি দিয়েছি।
.
শবে বরাতের দ্বিতীয় হাদীস নিয়ে মিথ্যাচারঃ
শবে বরাত সম্পর্কে আরেকটা (জাল) হাদীস খুব বেশি প্রচার করে বিদাতপন্থীরা। সেটি নিন্মরুপঃ
আলী (রা:) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যখন শাবানের ১৫ তারিখ আগমন করে, সে দিন তোমরা রোযা পালন কর এবং রজনীতে আল্লাহর ইবাদতে দন্ডায়মান থাক। কেননা, উক্ত দিবসে সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং জগতবাসীকে ডেকে বলেন, হে মানব জাতি! কেউ কি আছ তোমাদের মধ্যে ক্ষমা প্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। ওহে আছ কি তোমাদের কেউ অভাবী? আমি তার অভাব পূরণ করব। আছ কি কেউ বিপদগ্রস্থ? আমি তোমাদের বিপদ মুক্ত করব। আছ কি কেউ এই সমস্যায়? এমনি ভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত ডাকতে থাকবেন ।
এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে ইবনে মাজাহ ও মিশকাতে ১৩০৮ নাম্বার হাদীস।

সুনানে ইবনে মাজাতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে, এর পাশাপাশি বহু জয়ীফ হাদীসতো রয়েছে, এমনকি কয়েক ডজন জাল হাদীসও রয়েছে। উক্ত সনদে বর্ণিত এউ হাদীসটি জাল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। 
.
এই হাদীস হচ্ছে জাল (মানুষের বানানো কথা নবীর নামে চালানো হয়েছে)। কারণ এই হাদীস বর্ণনাকারীর একজন ইবন আবি বাসরাহ, যার সম্পর্ক ইমাম আহমাদ ও ইমাম ইবনে মাঈন বলেছেন, 
“ইবনে আবি বাসরাহ হাদীস জাল করতো।”
.
এখন পছন্দ আপনার। 
বিদাতী হুজুরদের প্রচার করা মিথ্যুক লোকদের থেকে বর্ণিত জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে শবে বরাত উদযাপন করবেন, নাকি বিদাতী আমল থেকে বিরত থেকে নবী (সাঃ) এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবেন?
.
ইমাম ইবনে আল-জাওযী আলাদা একটা বই লিখেছেন, সমস্ত জাল হাদীসগুলোকে একত্রিত করে “আল মাওজুয়াত” নামে। আর সেই বইয়ে (২/১২৭) তিনি ইবনে মাজাহতে বর্ণিত এই জাল হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া এই হাদীসটিকে জাল বলেছেন ইমাম ইবনে কাইয়্যিম তার আল-মানার আল-মুনীফ ফিল সহীহ ওয়াল জয়ীফ (পৃষ্ঠা ৯৮), ইমাম শওকানী তার আল-ফাওয়ায়েদ আল-মাজমুয়াতে (পৃষ্ঠা ৫১)।
.
যেহেতু আমাদের দেশের অধিকাংশ হুজুর মাওলানাদের সহীহ/জয়ীফ নিয়ে কোনো পড়াশোনা নাই, তাই এই সমস্ত জাল জয়ীফ হাদীস একটা কিছু পেলেই হলো, সুন্নতী আমলগুলো বাদ দিয়ে বেদাতকে প্রতিষ্ঠা করতে তারা উঠে পড়ে লেগে যায়। কিন্তু যিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদত নিয়ে তাদেরকে এতো উচ্চ-বাচ্য করতে দেখা যায়না, অথচ কুরআন হাদীসে এই দিনগুলোর ইবাদত নিয়ে কত ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
.
শবে বরাত নিয়ে শায়খ মতিউর রাহমান মাদানী হা'ফিজাহুল্লাহর লেকচারঃ
পর্ব-১


পর্ব-২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন